পুণ্যের বদলে পাপ হচ্চে নাতো? RAMADAN
ইসলামের মৌলিক পাঁচটি ভিত্তির অন্যতম একটি হলো রোজা। তাই কেউ এটি অস্বীকার করলে কাফের হয়ে যাবে এবং রোজা নিয়ে কটুক্তি করলে ঈমান চলে যাবে।
মৌলিক পাঁচটি ভিত্তি
ধনী-গরীব নির্বিশেষে সব বুদ্ধিমান সাবালক মুসলিম নর-নারীর উপর রোজা ফরজ। শরয়ী কোন ওজর ব্যতীত রোজা না রাখলে কবীরা গুনাহ হবে।
রোজার ইতিহাস বহু প্রাচীন। মুসলমানদের পূর্বেও অন্যান্য ধর্মে রোজার বিধান চালু ছিলো।
যেমন আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করেন- ‘ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিলো। নিঃসন্দেহে তোমরা (এ রোজার মাধ্যমে) মুত্তাকি (খোদাভীরু) হতে পারবে। (সুরা বাকারা- ১৮৩)
রোজার ফজিলত
সাধারণভাবে যে কোনো রোজাই অত্যন্ত পূণ্য ও সওয়াবের কাজ। এ প্রসঙ্গে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে।
এক হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- যে আল্লাহর রাস্তায় একদিন রোযা রাখবে আল্লাহ তা‘আলা সেই দিনের পরিবর্তে তার চেহারাকে জাহান্নাম থেকে সত্তর বছরের দূরত্বে সরিয়ে দিবেন।’ (বুখারি-২৮৪০)
* রোজা একান্তভাবে আমার-ই জন্যে। আর আমিই তার প্রতিদান দিবো। (বুখারি-১৯০৪)
রমজানের রোজার বিশেষ ফজিলত। সাধারণ রোজার পাশাপাশি রমজান মাসের রোজার বিশেষ কতিপয় বৈশিষ্ট্য ও ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।
* রোজাদারের (ক্ষুধার কারণে) মুখের গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের (এক প্রকার দারুণ সুগন্ধি) চেয়েও অধিক প্রিয়।
* ফেরেশতারা রোজাদারের জন্যে ইফতার করা পর্যন্ত ইস্তেগফার তথা গুনাহ মাফ চাইতে থাকে।
* রমজানের প্রতিদিন আল্লাহ তা‘আলা জান্নাতকে সুসজ্জিত করে বলেন- ‘আমার (রোজাদার) বান্দারা অচিরেই তাদের পরিশ্রম ও কষ্ট-ক্লেশ দূরে সরিয়ে তোমার কাছে পৌঁছে যাবে।
* এই মাসে লাইলাতুল কদর রয়েছে। যে রাত হাজার রাতের চেয়েও উত্তম। যে এ রাত্রের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো তবে সে সকল কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হলো।
* রমজানের শেষ রাতে রোজাদারদের ক্ষমা ঘোষনা করা হয়।
* এ মাসে একটি নফল ইবাদত (সওয়াবের ক্ষেত্রে) ফরজের সমতূল্য। আর একটি ফরজ সত্তরটি ফরজের সমতূল্য।
* যে পূর্ণ ঈমান ও সওয়াবের আশায় রমজানের রোজা রাখবে তার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ মাফ করে দেয়া হয়।
রমজানে বিশেষভাবে করণীয়
কুরআন তিলাওয়াতে যত্ম নেয়া: রমজান হলো কুরআনের মাস। এ মাসে হযরত জিব্রাইল (আ.) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে পূর্ণ কুরআন উপস্থাপন করতেন।
সাহাবায়ে কেরাম রমজান মাসে কুরআন নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়তেন। অনেক সাহাবী রমজানের প্রতিদিন কুরআন খতম করতেন। বহু পূর্বসুরী রমজান মাসে প্রতি তিন দিনে কুরআন খতম করতেন। তাই কুরআন তেলাওয়াতে বিশেষভাবে যত্ম নেয়া উচিত।
তারাবীহসহ আল্লাহ তায়ালার ইবাদাতে রাত্রি জাগরণ: হযরত উমর (রা.) রমজানের মধ্যরাতের পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিয়ে ‘নামাজ’ ‘নামাজ’ বলে উৎসাহ দিতেন। হযরত উসমান (রা.) রমজানের রাত্রে এমন দীর্ঘ নামায পড়তেন যে অনেক সময় এক রাকাতে পুরো কুরআন পড়ে ফেলতেন।
দান-সদকা করা: রমজান মাসে তাক্বওয়া অর্জনের আরেকটি মাধ্যম হলো সদকা। নিজের কষ্টার্জিত সম্পদ থেকে স্বত্ব ত্যাগ করে গরীব-দুঃখীদের মাঝে বিলিয়ে দেয়াকে সদকা বলে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সবচে’ বড় দানবীর। আর রমজান মাসে তিনি সর্বাধিক দান-সদকা করতেন। তিনি বলেন- সর্বোৎকৃষ্ট সদকা হলো রমজানের সদকা।
রোজাদারকে ইফতার করানো: হযরত সালমান (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- ‘যে রমজান মাসে কোন রোজাদারের ইফতারের ব্যবস্থা করবে তবে তার পাপ মোচন ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে এবং রোজাদারের মূল প্রতিদানের কোন অংশ কমানো ব্যতিরেকে সে রোযাদারের সমান প্রতিদান পাবে।
সাহাবারা বলে ওঠলেন- ইয়া রাসূলুল্লাহ! ইফতার করানোর মতো সামর্থ্য তো আমাদের সবার নেই! তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- ‘যারা একটুখানি দুধ বা একটি খেজুর বা এক ঢোক পানি দিয়ে হলেও কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে আল্লাহ তা‘য়ালা তাদেরকেও এই সওয়াব দিবেন।’ (ইবনে খুযাইমা ও বায়হাকী)
রমজানে বর্জনীয়:
সর্বপ্রকার গুনাহ বা পাপকর্ম ছেড়ে দেয়া। অনর্থক কাজ-কর্ম ও গল্প- গুজবে সময় নষ্ট না করা। অন্যের গীবত-শেকায়াত তথা পরনিন্দা না করা।
নাচ-গান, জুয়া ও সব ধরনের অশ্লীলতা-বেহায়াপনায় লিপ্ত না হওয়া। দিনের বেলা হোটেল-রেস্তোঁরা ইত্যাদি খোলা না রাখা ।
রমজানে সংযম ও আত্মত্যাগের অনুশীলন এবং সেই সাথে ইসলামভিত্তিক ন্যায়-নিষ্ঠা, সত্য ও সততা প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রত্যয় গ্রহণ প্রয়োজন।
ন্যায়-নিষ্ঠা ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্যে ত্যাগ ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় প্রমাণিত, শাশ্বত ও জীবন্ত। নৈতিকতা, শালীনতা ও একত্রে ইফতার গ্রহণের মাধ্যমে সহমর্মিতার সদভ্যাস গড়ে তুলে- ব্যষ্টিক ও সামষ্টিক কল্যাণ সাধনের পথ প্রশস্ত করার অনুশীলন করার মাস হচ্ছে- রমজান।
বাঙ্গালী মননে চিরায়ত ইসলামী মূল্যবোধ, ধ্যান-ধারণা, চরিত্র, ধর্ম ও আদর্শ রক্ষা এবং সর্বগ্রাসী অপরাধ প্রবণতা রোধের অনুশীলনের চেতনা জোরদার করার দারুণ সুযোগ আসে এ মাসে।
পরম করুণাময় অতি দয়ালু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সকাশে সকাতর আর্তি- তিনি যেন আমাদের সকলকে মাহে রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করার তৌফিক দান করেন এবং তার অফুরান অনুকম্পা ও করুণার বারিধারায় আমাদের সিক্ত করেন।
ই‘তিকাফ
রমজান মাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট মণ্ডিত আমল হলো শেষ দশ দিন ই‘তিকাফে থাকা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি বছর রমজানের শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ থাকতেন। তবে তার ইন্তিকালের বছর তিনি বিশ দিন ই‘তিকাফ ছিলেন।
সুতরাং ই‘তিকাফ যে কোন সময় হতে পারে। কিন্তু অধিক তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ হলো রমজানের শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ থাকা। যাতে লাইলাতুল ক্দর লাভের সৌভাগ্য হয়।
লাইলাতুল কদর
রমজান মাসের আরেক নেয়ামত হলো লাইলাতুল কদর। রমজানের শেষ দশ দিনের যে কোন বেজোড় রাত লাইলাতুল ক্দর হতে পারে। তবে অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের মতে ২৭ তম রাত্রি লাইলাতুল ক্দর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
লাইলাতুল ক্দরের গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্বন্ধে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘অবশ্যই আমি এ কুরআনকে লাইলাতুল ক্দরে অবতীর্ণ করেছি। আপনি (হে নবী) কি জানেন- লাইলাতুল ক্দর কি? তা হচ্ছে এমন এক রাত যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।’ (সুরা ক্দর:১-৩)
সদকাতুল ফিতর
সদকাতুল ফিতর রমজান মাসে দিতে হয় এমন একটি অনুদান। যাতে মুসলিম সমাজের অভাবী ব্যক্তিরাও যেন স্বাচ্ছন্দে ঈদ উদযাপন করতে পারে। ঈদের নামাজের পূর্বেই এই সদকা আদায় করতে হয়। সাহাবায়ে কেরাম ঈদের বেশ কয়েক দিন পূর্বে অভাবীদের কাছে এ সদকা পৌঁছে দিতেন। যাতে তারা ঈদের জামা-কাপড় এবং বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী কেনাকাটা করে খুশি মনে ঈদ উদযাপন করতে পারে ।
লাওহে মাহফুজ
আল্লাহ্ তায়ালা এ মাসে পবিত্র কোরআনুল কারিমের বিশেষ নিয়ামতে মানবতাকে ধন্য করেছেন, লাওহে মাহফুজ থেকে দুনিয়ার আকাশে সম্পূর্ণ কোরআন একবারে এ মাসেই অবতীর্ণ হয়। তাছাড়া ইবরাহিম (আ.) এর ওপর সহিফাসমূহ, দাউদ (আ.) এর ওপর যাবুর ও মুসা (আ.) এর ওপর তাওরাত এবং ঈসা (আ.) এর ওপর ইনজিল এ মাসেই অবতীর্ণ হয়।
মাসের শ্রেষ্ঠত্ব নয়
শুধুই সিয়াম সাধনাই এ মাসের শ্রেষ্ঠত্ব নয় বরং পবিত্র কোরআন নাজিল হওয়ার কারণেই এ মাসের মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই শুধু তেলাওয়াত নয় বরং কোরআনকে অর্থসহ বুঝে বুঝে অধ্যয়ন করা রমজানের গুরুত্বপূর্ণ দাবি। কোরআনের বিধি-বিধান জীবন ও সমাজে বাস্তবায়নই হবে রমজানের সবচেয় বড় শিক্ষা। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন, রমজান সে মাস, যে মাসে মানব জাতির পথ প্রদর্শনের নিদর্শনসমূহ ও ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী কোরআন নাজিল হয়েছে। অতএব, যে এই মাস পেল সে যেন অবশ্যই রোজা রাখে (সূরা বাকারা: ১৮৫)।
জিহ্বায় লাগাম
মুুমিন বান্দাদের উচিত, এ মাসে সিয়াম সাধনার পাশাপাশি নেক কাজ বাড়িয়ে দেওয়া। জানা সকল পাপ থেকে নিজেকে বিরত রাখা। অজানা পাপ থেকেও আল্লাহর কাছে কায়মনে আশ্রয় চাওয়া। হালাল রুজি ইবাদত কবুলের পূর্বশর্ত। রমজান যেহেতু মানুষকে হারাম থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে, তাই এ মাসেই হালাল রুজিতে অভ্যস্থ হওয়ার প্রশিক্ষণ নিতে হবে। সিয়াম অনর্থক কাজ থেকে বিরত রাখে, জিহ্বায় লাগাম টানে, হৃদয় পরিচ্ছন্ন রাখে, ব্যবহারকে সুন্দর করে, হিংসা-রেষারেষি থেকে মুক্তি লাভের শিক্ষা দেয়। তাই বিচ্ছিন্ন ও বিভক্ত মানবতাকে অভিন্ন সুতোয় বেঁধে নেওয়ার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাতে হবে এ মাসে। অধিকারবঞ্চিত মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্যও সোচ্চার হতে হবে সায়েমকে। আল্লাহর দুনিয়ায় মহান রবের রঙ ছড়িয়ে দেওয়ার দীপ্ত শপথ নিতে হবে এ মাসেই।
সুবর্ণ সময় রমজান
রমজানে পুণ্যের বদলে পাপ ও বক্রতা কোনও ব্যক্তির মধ্যে বেড়ে গেলে তা অবশ্যই আত্মিক পরাজয়, যার প্রভাব সমাজে পড়তে বাধ্য। রমজান শাসক-শাসিতে, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, উঁচু-নিচুদের মাঝে সেতুবন্ধনের একটি বড় মাধ্যম। অসৎ কাজ থেকে মানুষকে বারণ করার এক বিরাট সুযোগ। রমজান সামাজিক, চিন্তাগত অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকার একটি উপলক্ষ। মুসলমানদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনের সুবর্ণ সময় রমজান। তাই আমাদের উচিত রমজানে বেশি বেশি আত্মসমালোচনায় মনযোগী হওয়া। তাকওয়া অর্জিত হলেই কেবল রোজা আমাদের পাপকে জ্বালিয়ে দেবে। শুধু তেলাওয়াত নয়, বরং কুরআনকে অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ পড়ে আমল করা জরুরি। এর মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পারব আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য কী, আমরা কতটা মুত্তাকী হতে পেরেছি। বুঝতে পারবো- রোজা আসে রোজা যায়, তবুও সমাজ থেকে পাপাচার, অন্যায়, পশুত্ব, রাহাজানি কেন দূর হয় না। তাই এই রমজান হোক নিজেকে বদলে দেয়ার, পাপ-কালিমাকে মুছে দেয়ার, আর আল্লাহর রহমত পাওয়ার উপযোগী করে নিজেকে গড়ে তোলার বিশেষ নিয়ামত।